শ্বসন | Respiration
শ্বসন একটি বিপাকীয় ক্রিয়া। শ্বসনের বিপরীত প্রক্রিয়া হলো সালোকসংশ্লেষণ । যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীব কোষের জটিল জৈব যৌগসমূহ জারিত হয়ে সরল যৌগে পরিণত হয় এবং স্থিতিশক্তি রূপান্তরিত হয়ে গতিশক্তিতে পরিণত হয় তাই শ্বসন। এ সময় উপজাত হিসেবে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি নির্গত হয়। জীবের জীবন ধারণ অর্থাৎ চলন, ক্ষয়পুরণ, বৃদ্ধি, জনন প্রভৃতি জৈবিক কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। আমরা জানি এ শক্তির প্রধান উৎস হলো সূর্যালোক। সালোকসংশ্লেষণের সময় উদ্ভিদ সৌরশক্তিকে শর্করা জাতীয় খাদ্যবস্তুর মধ্যে স্থিতি শক্তিরূপে (Potential energy) সঞ্চয় করে রাখে। খাদ্যের মধ্যে সঞ্চিত এই ধরনের শক্তি জীব তার জীবন ধারণের জন্য সরাসরি ব্যবহার করতে পারে না। শ্বসনের সময় জীবদেহে এই স্থিতি শক্তি রাসায়নিক শক্তি (ATP) হিসেবে তাপরূপে মুক্ত হয় এবং জীবের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায়। শর্করা জাতীয় খাদ্যবস্তু ছাড়াও প্রোটিন, ফ্যাট এবং বিভিন্ন জৈব এসিড শ্বসনিক বস্তুরূপে ব্যবহৃত হয়। জীবদেহে এই জটিল যৌগগুলো প্রথমে ভেঙে সরল যৌগে পরিণত হয় এবং পরে জারিত হয়ে রাসায়নিক শক্তিতে (ATP) রূপান্তরিত হয়। সাধারণ তাপমাত্রায় জীবদেহের প্রতিটি কোষে দিবারাত্রি 24 ঘণ্টাই শ্বসন চলতে থাকে। তবে উদ্ভিদের বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে (ফুল ও পাতার কুঁড়ি, অঙ্কুরিত বীজ, মূল ও কাণ্ডের অগ্রভাগ) শ্বসন ক্রিয়ার হার অনেক বেশি। সজীব কোষের সাইটোপ্লাজম ও মাইটোকন্ড্রিয়াতে শ্বসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এ জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবদেহ যৌগিক খাদ্যদ্রব্য জারিত করে সরল দ্রব্যে পরিণত করে এবং শক্তি উৎপন্ন করে।
শ্বসনের প্রকারভেদ
শ্বসনের সময় অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে শ্বসনকে দুভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে সবাত শ্বসন ও অবাত শ্বসন।
সবাত শ্বসন
(Aerobic respiration): যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় এবং শ্বসনিক বস্তু (শর্করা, প্রোটিন, লিপিড, বিভিন্ন ধরনের জৈব এসিড) সম্পূর্ণভাবে জারিত হয়ে CO2, H2O এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে, তাকে সবাত শ্বসন বলে। সবাত শ্বসনই হলো উদ্ভিদ ও প্রাণীর স্বাভাবিক শ্বসন প্রক্রিয়া। সবাত শ্বসনের সামগ্রিক সমীকরণটি এরকম:
C6H12O6 + 602 → বিভিন্ন এনজাইম → 6CO2 + 6H2O + শক্তি (686 k Cal / Mole) গ্লুকোজ
সবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় এক অণু গ্লুকোজ সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে সর্বমোট 6 অণু CO2, 6 অণু পানি এবং 38টি ATP উৎপন্ন করে।
অবাত শ্বসন
(Anaerobic respiration): যে শ্বসন প্রক্রিয়া অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে হয়, তাকে অবাত শ্বসন বলে। অর্থাৎ যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় কোনো শ্বসনিক কস্তু অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়াই কোষের ভিতরকার এনজাইম দিয়ে আংশিকরূপে জারিত হয়ে বিভিন্ন প্রকার জৈব যৌগ (ইথাইল অ্যালকোহল, ল্যাকটিক এসিড ইত্যাদি), CO2 এবং সামান্য পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে, তাকে অবাত শ্বসন বলে।
CaH12O6 এনজাইম → 2C2H5OH + 2CO2 + শক্তি (56 k Cal / Mole)
কেবল মাত্র কিছু অণুজীবে যেমন ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট ইত্যাদিতে অবাত শ্বসন হয়ে থাকে। সবাত শ্বসন প্রক্রিয়া সাধারণত চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। ধাপগুলো এরকম:
ধাপ ১: গ্লাইকোলাইসিস
(Glycolysis): এই প্রক্রিয়ায় এক অণু গ্লুকোজ (C6H12O6) বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জারিত হয়ে দুই অণু পাইরুভিক এসিড (C3H4O3) উৎপন্ন করে। এই ধাপে চার অণু ATP (এর মাঝে দুই অণু খরচ হয়ে যায়) এবং দুই অণু NADH+H+ উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়ার জন্য কোনো অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না, তাই গ্লাইকোলাইসিস সবাত ও অবাত উভয় প্রকার শ্বসনেরই প্রথম পর্যায়। গ্লাইকোলাইসিসের বিক্রিয়াগুলো কোষের সাইটোপ্লাজমে ঘটে থাকে।
ধাপ ২: অ্যাসিটাইল কো-এ সৃষ্টি: গ্লাইকোলাইসিস পর্যায়ে সৃষ্ট প্রতি অণু পাইরুভিক এসিড পর্যায়ক্রমিক বিক্রিয়া শেষে 2 কার্বনবিশিষ্ট এক অণু অ্যাসিটাইল কো এনজাইম-এ (Acetyl Co-A), এক অণু CO₂ এবং এক অণু NADH+H+ (অথবা NADH₁) উৎপন্ন করে (অর্থাৎ দুই অণু পাইরুভিক এসিড থেকে দুই অণু অ্যাসিটাইল কো এনজাইম-এ, দুই অণু CO2 এবং দুই অণু NADH+H+ উৎপন্ন হয়)। এই ধাপটি সাইটোপ্লাজমে ঘটে বলে এক সময় মনে করা হতো, তবে সর্বশেষ তথ্য উপাত্ত অনুসারে জানা গেছে বিক্রিয়াটি ঘটে মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে।
ধাপ ৩ :
ক্রেবস চক্র (Krebs cycle): ইংরেজ প্রাণরসায়নবিদ Sir
Hans Krebs এ চক্রটি আবিষ্কার করেন বলে একে ক্রেবস চক্র বলা হয়। এ পর্যায়ে অ্যাসিটাইল Co-A মাইটোকন্ড্রিয়াতে প্রবেশ করে এবং ক্রেবস চক্রে অংশগ্রহণ করে। এ চক্রের সকল বিক্রিয়াই মাইটোকন্ড্রিয়াতে সংঘটিত হয়। এই চক্রে এক অণু অ্যাসিটাইল Co-A থেকে দুই অণু কার্বন ডাইঅক্সাইড, তিন অণু NADH+H+, এক অণু FADH, এবং এক অণু GTP (গুয়ানোসিন ট্রাইফসফেট) উৎপন্ন হয় (অর্থাৎ দুই অণু অ্যাসিটাইল Co-A থেকে চার অণু CO2, 6 অণু NADH+H+, দুই অণু FADH, এবং দুই অণু GTP উৎপন্ন হয়)। উল্লেখ্য, প্রাণিকোষের ক্রেবস চক্রে কখনো কখনো GTP এর পরিবর্তে সরাসরি ATP উৎপন্ন হতে পারে কিন্তু প্রায় সমস্ত উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এই চক্রে GTP এর পরিবর্তে সবসময়ই ATP উৎপন্ন হয়। পরবর্তী ধাপ ইলেকট্রন প্রবাহতন্ত্রে যেহেতু এক অনু GTP এর সমতুল্য হিসেবে এক অনু ATP উৎপন্ন হয়, সেহেতু এই পার্থক্যটি ক্রেবস চক্র থেকে উৎসারিত মোট শক্তির পরিমাণে কোনো তারতম্য ঘটায় না।
ধাপ ৪: ইলেকট্রন প্রবাহতন্ত্র
(Electron transport system): উপরোক্ত তিনটি ধাপে যে NADH+H+ (বিজারিত NAD), FADH, (বিজারিত FAD) উৎপন্ন হয়, এই ধাপে সেগুলো জারিত হয়ে ATP, পানি, উচ্চশক্তির ইলেকট্রন এবং প্রোটন উৎপন্ন হয়। উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রনগুলো ইলেকট্রন প্রবাহতন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় যে শক্তি প্রদান করে সেই শক্তি ATP তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ইলেকট্রন প্রবাহতন্ত্র মাইটোকন্ড্রিয়ায় সংঘটিত হয় ।
অর্থাৎ সবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় এক অণু গ্লুকোজ সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে সর্বমোট ছয় অণু CO2 ছয় অণু পানি এবং 3৪টি ATP উৎপন্ন করে। নিচের চার্টে সেটি দেখানো হলো:
শ্বসনের পর্যায় |
উৎপাদিত বস্তু |
ব্যয়িত বস্তু |
নিট উৎপাদন |
গ্লাইকোলাইসিস |
2 অণু পাইরুভিক এসিড |
2 অণু ATP |
6 অণু ATP |
অ্যাসিটাইল Co-A |
2 অণু অ্যাসিটাইল Co-A |
2 অণু পাইরুভিক এসিড |
2 অণু CO2 |
ক্রেবস চক্র |
4 অণু CO2 |
2 অণু অ্যাসিটাইল Co-A |
4 অণু CO2 |
মোট |
38 অণু ATP + 6 অণু CO2 |
·
1 অণু NADH+H+ বা NADH2 → 3 অণু ATP
·
1 অণু FADH2 → 2 অণু ATP
·
1 অণু GTP → 1 অণু ATP
অবাত শ্বসনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা : দুটি ধাপে অবাত শ্বসন হয়ে থাকে। ধাপ দুটি হলো:
ধাপ ১: গ্লুকোজের অসম্পূর্ণ জারণ: এই ধাপে এক অণু গ্লুকোজ থেকে দুই অণু পাইরুভিক এসিড, চার অণু ATP (এর মধ্যে দুই অণু ব্যবহার হয়ে যায়) এবং দুই অণু NADH+H+ উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে এ পর্যন্ত বিক্রিয়া সবাত শ্বসনের গ্লাইকোলাইসিসের অনুরূপ। তবে উৎপন্ন পাইরুভিক এসিড পরবর্তী ধাপে বিজারিত হয়ে যায় বলে অবাত শ্বসনে গ্লুকোজের অসম্পূর্ণ জারণ ঘটে- এমনটা বিবেচনা করা হয়।
ধাপ ২: পাইরুভিক অ্যাসিডের বিজারণ: সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত এনজাইমের কার্যকারিতায় পাইরুভিক অ্যাসিড বিজারিত হয়ে CO2 এবং ইথাইল অ্যালকোহল অথবা শুধু ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে। এক্ষেত্রে গ্লাইকোলাইসিসে উৎপন্ন বিজারিত NAD (অর্থাৎ NADH+H+) জারিত হয়ে যে ইলেকট্রন, প্রোটন ও শক্তি নির্গত করে, তা ব্যবহৃত হয় পাইরুভিক অ্যাসিড থেকে ল্যাকটিক অ্যাসিড বা ক্ষেত্রবিশেষে ইথানল উৎপাদনের জন্য। অন্যদিকে, অক্সিজেনের অভাবে তখন অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশনও চলে না। তাই অবাত শ্বসনের ক্ষেত্রে এক অণু গ্লুকোজের গ্লাইকোলাইসিসে নিট মাত্র 2 অণু ATP পাওয়া যায়।
শ্বসন প্রক্রিয়ার প্রভাবকসমূহ
শ্বসন প্রক্রিয়ার প্রভাবকগুলো বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুরকম হতে পারে।
বাহ্যিক প্রভাবক: বাহ্যিক প্রভাবকগুলো হলো:
·
তাপমাত্রা: 20° সেলসিয়াসের নিচে এবং 45° সেলসিয়াসের উপরের তাপমাত্রায় শ্বসন হার কমে যায়। শ্বসনের জন্য উত্তম তাপমাত্রা 20° সেলসিয়াস থেকে 45° সেলসিয়াস।
·
অক্সিজেন: সবাত শ্বসনে পাইরুভিক এসিড জারিত হয়ে CO2 ও H2O উৎপন্ন করে। কাজেই অক্সিজেনের অভাবে সবাত শ্বসন কোনোক্রমেই চলতে পারে না।
·
পানি: পরিমিত পানি সরবরাহ শ্বসন ক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখে। কিন্তু অত্যন্ত কম কিংবা অতিরিক্ত পানির উপস্থিতিতে শ্বসন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
·
আলো: শ্বসন কার্যে আলোর প্রয়োজন পড়ে না সত্যি কিন্তু দিনের বেলা আলোর উপস্থিতিতে পত্ররন্ধ্র খোলা থাকায় O2 গ্রহণ ও CO2 ত্যাগ করা সহজ হয় বলে শ্বসন হার একটু বেড়ে যায়।
·
কার্বন ডাই-অক্সাইড: বায়ুতে CO2 -এর ঘনত্ব বেড়ে গেলে শ্বসন হার একটুখানি কমে যায়।
অভ্যন্তরীণ প্রভাবক: অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলো হলো:
·
খাদ্যদ্রব্য: শ্বসন প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্য (শ্বসনিক বস্তু) ভেঙ্গে শক্তি, পানি এবং CO2 নির্গত করে, তাই কোষে খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ ও ধরন শ্বসন হার নিয়ন্ত্রণ করে।
·
উৎসেচক: শ্বসন প্রক্রিয়ায় অনেক ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কাজেই এনজাইমের ঘাটতি শ্বসনের হার কমিয়ে দেয়।
·
কোষের বয়স: অল্পবয়স্ক কোষে, বিশেষ করে ভাজক কোষে প্রোটোপ্লাজম বেশি থাকে বলে সেখানে বয়স্ক কোষ থেকে শ্বসনের হার বেশি।
·
অজৈব লবণ: কোনো কোনো লবণ শ্বসন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করলেও কোষের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক কাজের জন্য এবং স্বাভাবিক শ্বসন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য কোষের ভিতরে অজৈব লবণ থাকতে হয়।
·
কোষমধ্যস্থ পানি: বিভিন্ন শ্বসনিক বস্তু দ্রবীভূত করতে এবং এনজাইমের কার্যকারিতা প্রকাশের জন্য পানির প্রয়োজন।
শ্বসনের গুরুত্ব
শ্বসন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তি দিয়ে জীবের সব ধরনের ক্রিয়া-বিক্রিয়া এবং কাজকর্ম পরিচালিত হয়। শ্বসনে নির্গত CO2 জীবের প্রধান খাদ্য শর্করা উৎপন্নের জন্য সালোকসংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। এ প্রক্রিয়া উদ্ভিদে খনিজ লবণ পরিশোষণে সাহায্য করে, যা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং অন্যান্য জৈবিক প্রক্রিয়া চালু রাখে। কোষ বিভাজনের প্রয়োজনীয় শক্তি ও কিছু আনুষঙ্গিক পদার্থ শ্বসন প্রক্রিয়া থেকে আসে। তাই বলা যেতে পারে এ প্রক্রিয়া জীবের দৈহিক বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণ করে। এ প্রক্রিয়া বিভিন্ন উপক্ষার ও জৈব এসিড সৃষ্টিতে সহায়তা করার মাধ্যমে জীবনের অন্যান্য জৈবিক কাজেও সহায়তা করে।
কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বাঁচতে পারে না। এদের শক্তি উৎপাদনের একমাত্র উপায় হলো অবাত শ্বসন। এ প্রক্রিয়ায় ইথাইল অ্যালকোহল তৈরি হয়, যা বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। ল্যাকটিক এসিড ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ায় দই, পনির ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। রুটি তৈরিতে এ প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। ইস্টের অবাত শ্বসনের ফলে অ্যালকোহল এবং CO2, গ্যাস তৈরি হয়। এই CO2 প্যাসের চাপে রুটি ফুলে গিয়ে ভিতরে ফাঁপা হয়। আসে। তাই বলা যেতে পারে এ প্রক্রিয়া জীবের দৈহিক বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণ করে। এ প্রক্রিয়া বিভিন্ন উপক্ষার ও জৈব এসিড সৃষ্টিতে সহায়তা করার মাধ্যমে জীবনের অন্যান্য জৈবিক কাজেও সহায়তা করে।
সালোকসংশ্লেষণ | Photosynthesis
সবুজ উদ্ভিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যে এরা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পানি থেকে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাদ্য তৈরি করে। সবুজ উদ্ভিদে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য তৈরি হওয়ার এ প্রক্রিয়াকে সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় আলোকশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সবুজ উদ্ভিদে প্রস্তুত খাদ্য উদ্ভিদ নিজে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ব্যবহার করে এবং অবশিষ্ট খাদ্য ফল, মূল, কাণ্ড অথবা পাতায় সঞ্চিত রাখে। উদ্ভিদে সঞ্চিত এই খাদ্যের উপরেই মানবজাতি ও অন্যান্য জীবজন্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে। সবুজ উদ্ভিদ মোট সূর্যালোকের মাত্র ১% সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে সংবন্ধিত হয়।
সালোকসংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হলো: ক্লোরোফিল, আলো, পানি এবং কার্বন ডাই- অক্সাইড। সালোকসংশ্লেষণ একটি জৈব রাসায়নিক (biochemical) বিক্রিয়া, যেটি এরকম:
6CO2 + 12H2O আলো → ক্লোরোফিল C6H12O6 + 6H2O + H2O
পাতার মেসোফিল টিস্যু সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার প্রধান স্থান। স্থলজ সবুজ উদ্ভিদ মাটি থেকে মূলের মাধ্যমে পানি শোষণ করে পাতার মেসোফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্টে পৌঁছায় এবং স্টোমা বা পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে বায়ু থেকে CO2 গ্রহণ করে, যা মেসোফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্টে পৌঁছে। জলজ উদ্ভিদ পানিতে দ্রবীভূত CO2 গ্রহণ করে। বায়ুমণ্ডলে 0.03% এবং পানিতে 0.3% CO2, আছে, তাই জলজ উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণের হার স্থলজ উদ্ভিদ থেকে বেশি। অক্সিজেন এবং পানি সালোকসংশ্লেষণের উপজাত দ্রব্য (by-product)। এটি একটি জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া (oxidation-reduction
process)। এ প্রক্রিয়ায় H2O জারিত হয় এবং CO2 , বিজারিত হয়।
·
সালোক সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ: চারটি। যেমন: আলো, পানি, ক্লোরোফিল ও কার্বন ডাই অক্সাইড। পাতায় ক্লোরোপ্লাস্টের সংখ্যা ও ক্লোরোফিলের পরিমাণের ওপর সালোক সংশ্লেষণ সরাসরি নির্ভরশীল।
·
সালোক সংশ্লেষনের ফলে শর্করা জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়। উপজাত হিসাবে পাওয়া যায় অক্সিজেন।
·
সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় নির্গত অক্সিজেনের উৎস: পানি।
·
সালোক সংশ্লেষণ হয় উদ্ভিদের সবুজ অংশে বিশেষ করে পাতায়। কচি সবুজ কাণ্ডে এবং সবুজ বীজপত্রে সালোক সংশ্লেষণ হয়।
·
সালোকসংশ্লেষণ বেশি হয়- (২২-৩৫)°C তাপমাত্রায়।
·
সালোকসংশ্লেষণ হয় না/ বন্ধ হয়ে যায়- অতি নিম্ন তাপমাত্রায় (0°এর কাছাকাছি) এবং অতি উচ্চ তাপমাত্রায় (৪৫°এর উপরে)।
·
১৯০৫ সালে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেন ইংরেজ শরীরতত্ত্ববিদ ব্র্যাকম্যান (Blackman)।
·
সালোকসংশ্লেষণের পর্যায় দুটি - ক) আলোক পর্যায় খ) অন্ধকার পর্যায়
·
সালোকসংশ্লেষণের অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলো হলো ক্লোরোফিল, পাতার বয়স ও সংখ্যা, শর্করার পরিমাণ, পটাশিয়াম, এনজাইম।
·
কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ খুব বেশি বেড়ে গেলে মেসোফিল টিস্যুর কোষের অম্লত্ব বৃদ্ধি পায় ।
·
পত্ররন্ধ্র বন্ধ হয়ে যায় এবং সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায়।
·
যে এককোষী প্রাণীতে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে - ক্রাইস্যামিবা (Chrysamoeba). ও ইউগ্লিনা (Euglena) তে।
ফটোফসফোরাইলেশন: আলোকশক্তি ব্যবহার করে ATP তৈরির প্রক্রিয়াকে ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
ক্যালভিন ও ব্যাশাম চক্র: সালোকসংশ্লেষণের অন্ধকার পর্যায়ে বায়ুমণ্ডলের CO2 ব্যবহার করে শর্করা তৈরির চক্রকে ক্যালভিন ও ব্যাশাম চক্র বলে।
কোন আলোতে সালোক সংশ্লেষণ সবচেয়ে বেশী হয়: ক্লোরোফিল বিশেষ বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করতে পারে। লাল আলোতে সালোক সংশ্লেষণ সবচেয়ে বেশি হয়। সালোক সংশ্লেষণের সময় আলোর বেগুনি-নীল এবং কমলা-লাল অংশ বেশি ব্যবহৃত হয়। বাকি বর্ণের আলো খুবই কম ব্যবহৃত হয়।
ঘন পাতাবিশিষ্ট বৃক্ষের নিচে রাতে ঘুমানো স্বাস্থ্যসম্মত নয় কেন: শ্বসন দিবারাত্র সবসময় হয়। প্রত্যেক জীব শ্বসনের জন্য অক্সিজেন গ্রহন করে, কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। গাছ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহন করে, অক্সিজেন ত্যাগ করে। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সালোক সংশ্লেষণ হয় বলে রাতে সালোক সংশ্লেষণ বন্ধ থাকে। এজন্য রাতে গাছ থেকে শ্বসনের ফলে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত করে যা বায়ু অপেক্ষা ভারী বলে গাছের নীচে জমা হতে পারে। এতে গাছের নীচ নিদ্রাযাপন কারী ব্যক্তির অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। এ জন্য রাতে ঘন পাতাবিশিষ্ট বৃক্ষের নীচে ঘুমানো স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
সকল সপুষ্পক উদ্ভিদ কি স্বভোজী: সকল সপুষ্পক উদ্ভিদে ক্লোরোফিল বিদ্যমান। ফলে এরা সূর্যের আলোর সাহায্যে সালোকংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের খাদ্য নিজেরাই প্রস্তুত করতে পারে। তাই এরা স্বভোজী।
সালোক সংশ্লেষনের হার কমে যায় যদি-
·
০° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার কাছাকাছি এবং ৪৫° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার উপরে।
·
পানির পরিমাণ কমে গেলে।
·
কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান কমে গেলে।
·
বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে গেলে।
·
মাটিতে নাইট্রোজেন, ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রনের পরিমান কমে গেলে।
·
বাতাসে ক্লোরোফরম, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন বা কোন বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতিতে।
·
কচি পাতা এবং বয়স্ক পাতায় সালোক সংশ্লেষনের হার কম হয়।
·
বিকালে সালোক সংশ্লেষনের পরিমাণ কম হয়।
রাতের বেলায় সালোক সংশ্লেষন হয় না কেন: রাতের বেলায় সূর্যালোক নেই বলে কারণ সূর্যালোকের ফোটন কণিকা ক্লোরোফিল সক্রিয় করে।
·
শর্করা উৎপাদনের প্রাকৃতিক কারখানা বলা হয়: গাছের সবুজ পাতাকে ।
·
কোন উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষনের হার বেশি: জলজ উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষনের হার বেশি কারণ, জলজ উদ্ভিদে CO2 এর পরিমান ০.৩% বেশি। বিঃদ্রঃ উদ্ভিদ যত বেশি CO2 পাবে সালোক সংশ্লেষনের হার বৃদ্ধি পাবে।
·
সালোক সংশ্লেষন বেশি হয়: মধ্য বয়সী পাতায় বেশি হয় এবং কচি পাতায় কম হয়, (কারণ কচি পাতায় ক্লোরোফিল কম থাকে)।
ক্লোরোফিল: ক্লোরোফিল হলো সবুজ বণের রঞ্জক কণিকা। যা উয়িদের সবুজ অংশে পাওয়া যায় বিশেষ করে পাতার মেসোফিল কোষে থাকে। ক্লোরোফিলের কাজ উদ্ভিদের খাদ্য তরিতে সাহায্য করে। অর্থাৎ সৌরশক্তি হইতে আলোকশক্তি শোষণ করে সর্বশেষ রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
·
উদ্ভিদের ক্লোরাফিলে কোন ধাতব অণু থাকে: ম্যাগনেসিয়াম থাকে।
·
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার প্রধান স্থান পাতার মেসোফিল টিস্যু।
·
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তিকে কোন শক্তি হিসাবে গাছ সংরক্ষণ করে: রাসায়নিক শক্তি হিসাবে।
·
সালোক সংশ্লেষণ কি ধরনের প্রক্রিয়া: একটি জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া।
·
সালোক সংশ্লেষণের অভ্যন্তরীণ প্রভাবক হিসাবে কোন ধাতু কাজ করে: পটাশিয়াম ধাতু।
·
উদ্ভিদ কোনটির মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে: উদ্ভিদ পত্ররন্ধের মাধ্যমে বায়ু থেকে CO2 গ্রহণ করে। জলজ উদ্ভিদ পানিতে দ্রবীভূত CO2 গ্রহণ করে। (পানিতে ০.৩% CO₂আছে) জলজ উদ্ভিদে সালোক সংশ্লেষনের হার স্থলজ উদ্ভিদ থেকে বেশি।
·
ATP কে কি বলা হয়: ATP
(Adelosine Triphosphate) কে জৈবমুদ্রা বা শক্তি মুদ্রা (Biological coin or
energy coin) বলে
অনুশীলন অধ্যায়
১. খাদ্য তৈরীর জন্য উদ্ভিদ বায়ু থেকে গ্রহণ করে - [৪০তম বিসিএস ]
·
অক্সিজেন
·
কার্বন ডাই-অক্সাইড
·
নাইট্রোজেন
·
জলীয় বাষ্প
২. কোন প্রক্রিয়ার উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করে ? [প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক (দ্বিতীয় ধাপ) ২০১৯ ]
·
শ্বসন
·
প্রস্বেদন
·
অভিস্রবণ
·
সালোক সংশ্লেষণ
৩. সূর্যের আলো থেকে আগত শক্তির কতটুকু সবুজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে ? [তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ক্যামেরাম্যান ২০১৯ ]
·
১%
·
২%
·
৩%
·
৪%
৪. সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তৈরি মূল পদার্থটি কি ? [গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় অফিসার, আরবরিকালচার :
০৩) বৃক্ষ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কোন জাতীয় খাদ্য তৈরি করে? [ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নার্সিং ও মিডওয়াইফ অধিদপ্তরের মিডওয়াইফ ২০১৭ ]
·
পানি
·
শর্করা
·
আমিষ
·
অক্সিজেন
৫. সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুত করে কোষের কোন অঙ্গ ? [কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা-২০১৪ ]
·
সাইটোপ্লাজম
·
নিউক্লিয়াস
·
ক্লোরোপ্লাস্ট
·
গলজি বস্তু
৬. সালোকসংশ্লেষণ একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া, সেখানে তৈরি হয়- [মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রদর্শক : ২০১৩ ]
·
O2
·
CO2
·
SO4
·
DNA
৭. গাছ খাদ্য উৎপাদনের সময় বায়ুমন্ডল থেকে কোন পদার্থ গ্রহণ করে ? [স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক-২০১৩ ]
·
অক্সিজেন
·
হাইড্রোজেন
·
নাইট্রোজেন
·
কার্বন ডাই-অক্সাইড
৮. পাতার ক্লোরোফিল সহায়তা করে- [প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাব সহকারী ২০১৩ ]
·
খাদ্য তৈরিতে
·
শ্বসন প্রক্রিয়ায়
·
পরাগায়নে
·
বংশ বৃদ্ধিতে
৯. কোনটি প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক- [মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষকঃ ০১ ]
·
মানুষ
·
উদ্ভিদ
·
সবুজ উদ্ভিদ
·
প্রাণী
১০. ক্লোরোফিল ছাড়া সম্পন্ন হয় না- [ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাঃ ০৬ ]
·
শ্বসন
·
অভিস্রবন
·
রেচন
·
সালোকসংশ্লেষণ