Ethics, Values, and Good Governance" (lec 1)

বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রস্তুতি (BCS) Preliminary Preparation 200 Marks নৈতিকতা-মূল্যবোধ-সুশাসন

সুশাসন - বিসিএস প্রস্তুতি

 

 

সুশাসন ধারণার উদ্ভাবক বিশ্বব্যাংক। ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় সর্বপ্রথম 'সুশাসন' (Good Governance) প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়। এটি আধুনিক শাসন ব্যবস্থার সংযোজিত রূপ। ইংরেজি গভর্নেন্স (Governance) শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ 'kubernan' থেকে। 'গভর্নেন্স' প্রপঞ্চটির সাথে 'সু' প্রত্যয় যোগ করে 'সুশাসন' বা Good Governance শব্দটির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। Good Governance শব্দটি Good এবং Governance- দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, যার অর্থ-নির্ভুল, দক্ষ কার্যকরী শাসন। বিশ্বব্যাংকের মতে, সুশাসন চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর নির্ভরশীল। আর চারটি স্তম্ভ দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা, আইনি কাঠামো এবং অংশগ্রহণ। বর্তমানে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে 'সুশাসন' শব্দটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সুশাসন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে শাসক শাসিতের সম্পর্ক কি হবে, রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, রাষ্ট্র সরকার, সরকার জনগণ কিংবা রাষ্ট্র জনগণ অথবা তিনটির মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হবে বা হওয়া উচিত তার একটি রূপরেখা সুশাসনের মাধ্যমে চিত্রায়িত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ কল্যাণমুখী। গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসনের আশা করা যায় না। গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকে। বিশ্বের সব দেশের সরকার নিজেদের রাষ্ট্রকে কল্যাণ রাষ্ট্র আর সরকারকে সুশাসনের সরকার বলে দাবি করে থাকে। মূলত বেশির ভাগ দেশে সুশাসন কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে, বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। কাজেই গণতন্ত্রকে সফল করার পূর্বশর্ত হিসেবে এখন সুশাসন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিরাজমান সকল জটিলতার সমাধান ঘটিয়ে সর্বাধিক জনকল্যাণ সাধন করাই সুশাসনের লক্ষ্য।


Table of Content 

 

·          সুশাসনের সংজ্ঞা

·          সুশাসনের উপাদান

·          সুশাসনের উপাদানসমূহ সমাজে প্রতিষ্ঠা

·          সুশাসনের সমস্যাবলি

·          সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকা

·          সামাজিক জাতীয় আদর্শ গঠন এবং ব্যক্তিগত নাগরিক জীবনে সুশাসনের গুরুত্ব

·          সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য

·          জাতীয় উন্নয়নে সুশাসনের প্রভাব

·          সুশাসন প্রতিষ্ঠায় -গভর্নেন্স

·          -গভর্নেন্স-এর কার্যক্রম

·          সুশাসনের উপকারিতা

·          সুশাসনের অভাবজনিত ফলাফল

·          সুশীল সমাজ

·          চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী

·          ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি

·          বাংলাদেশ সুশাসন

 

সুশাসনের সংজ্ঞা

সুশাসনের ধারণাটি বহুমাত্রিক। এটি ধরনের ধারণা নির্মাণ করে; রাজনৈতিক সুশাসন, সামাজিক সুশাসন, অর্থনৈতিক সুশাসন এবং সাংস্কৃতিক সুশাসন। বিভিন্ন তাত্ত্বিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা দাতা সংস্থা 'সুশাসন' ধারণাটির সংজ্ঞা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯২ সালে সুশাসনের সংজ্ঞা প্রদান করে 'শাসন প্রক্রিয়া এবং উন্নয়ন' (Governance and Development) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে-
"
সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রযোগের পদ্ধতিই হলো সুশাসন।"
ইউ এন ডি পি (UNDP) ১৯৯৭ সালে 'স্থায়ী মানব উন্নয়নের জন্য শাসন' (Governance for Sustainable Human Development) শিরোনামে এর নীতি নথিতে সুশাসনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। এতে বলা হয়েছে-
"
কোন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সকল পর্যায়ের কাজে। মধ্যে শাসনপ্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা যায়।"
The Social Encyclopaedia
তে 'সুশাসন' সম্পর্কে বলা হয়েছে-
"
এটি সরকার পরিচালনা অপেক্ষা একটি বিস্তৃত ধারণা যা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহারের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকার সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।"
ম্যাককরনির মতে-
"
সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বুঝায়।"
মার্টিন মিনোগের মতে-
"
বৃহৎ অর্থে সুশাসন হচ্ছে কতিপয় উদ্যোগের সমাহার একটি সংস্কার কৌশল যা সরকারকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা, স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক করার জন্য সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলে।"
আইএমএফ এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিশেল ক্যামডোসাস ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে সুশাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
"
রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সুশাসন আবশ্যক" (Good Governance is essential for countries at all stages of development)

মোটকথা সুশাসন হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিফলন যেখানে শাসক শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে, সর্বোচ্চ স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকবে, আইনের শাসন থাকবে, নীতির গণতন্ত্রায়ন থাকবে, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে, মতামত পছন্দের স্বাধীনতা থাকবে এবং স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা থাকবে। জাতিসংঘের ভাষায়- 'সুশাসনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো, মৌলিক স্বাধীনতার উন্নয়ন'

 

পশ্চিমা বিশ্বের মতামত :
'
সুশাসন' বিষয়টি একটি বহুমাত্রিক এবং একটি আন্তর্জাতিক ধারণা। পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ সুশাসনের চারটি দিকের কথা উল্লখ করেছে। যথা-

. সুশাসন অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনাকে বুঝায়

. সুশাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

. রাজনৈতিক প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ যাতে উত্তম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

. প্রশাসনিক দক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে শাসন কাঠামোর অন্যতম দিক।

 

দাতা সংস্থার মতামত :
সুশাসন ধারণাটি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক উদ্ভাবিত হলেও এর ব্যাখ্যা প্রদান করে বিভিন্ন দাতা সহযোগী সংস্থা। দাতা সংস্থাগুলো সুশাসনের কয়েকটি নির্দেশনা প্রদান করেছে। যথা-

. রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং একটি অবাধ নির্বাচিত আইনসভা

. ব্যক্তি সত্তার অধিকার সংরক্ষণে সংবিধান এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

. স্থিতিশীল মুদ্রা ব্যবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ।

. শিক্ষা স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন।

. একটি স্বাধীন নির্বাচিত আইনসভার নিকট নির্বাহী কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি প্রভৃতি

 

সুশাসনের উপাদান

জাতিসংঘ সুশাসনের টি মূল উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। যথা-

·         ) অংশগ্রহণ (Participation)

·         ) আইনের শাসন (Rule of law)

·         ) স্বচ্ছতা (Transparency)

·         ) সহানুভূতিশীলতা (Responsiveness)

·         ) ঐক্যমতাভিত্তিক (Consensus oriented)

·         ) ন্যায়বিচার অন্তর্ভুক্তিকরণ (Equity and inclusiveness)

·         ) কার্যকারিতা দক্ষতা (Effectiveness and efficiency)

·         ) জবাবদিহিতা (Accountability).

UNDP (United Nations Development Programe) সুশাসন নিশ্চিত করতে ৯টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। যথা-

·         ) অংশগ্রহণ (Participation)

·         ) আইনের শাসন (Rule of law)

·         ) স্বচ্ছতা (Transparency)

·         ) সহানুভূতিশীলতা (Responsiveness)

·         ) ঐক্যমত্য অভিযোজন (Cor sensus orientation)

·         ) ন্যায়পরায়ণতা (Equity)

·         ) কার্যকারিতা দক্ষতা (Effectiveness and efficiency)

·         ) জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতা (Accountability) এবং

·         ) কৌশলগত দৃষ্টি (Strategic vision)

বিশ্বব্যাংক সুশাসনের টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। যথা-

·         ) সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থাপনা (Public sector management)

·         ) জবাবদিহিতা (Accountability)

·         ) উন্নয়নের বৈধ কাঠামো (Legal framework for development)

·         ) স্বচ্ছতা এবং তথ্যপ্রবাহ (Transparency and information)

কৌটিল্য সুশাসনের ৪টি উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা-

·         ) Law and Order

·         ) People caring Administration

·         ) Justice and Rationality as the basis of Decision

·         8) Corruption Free Governance.

 

আফ্রিকান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ১৯৯৯ সালে সুশাসনের টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। যথা-

·         ) জবাবদিহিতা (Acoountability)

·         ) স্বচ্ছতা (Transparency)

·         ) দুর্নীতি প্রতিরোধ (Combating corruption)

·         ) অংশগ্রহণ (Participation)

·         ) আইন বিচার ব্যবস্থার সংস্কার সাধন (Legal and judicial refoms)

 

সুশাসনের উপাদানসমূহ সমাজে প্রতিষ্ঠা

সুশাসন বা ভাল শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে যা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই উপাদানগুলি হলো:

নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা : ইউরোপীয় কমিশনের মতে, সুশাসনের ভিত্তি হলো নীতি মূল্যবোধ (Principles and values) ন্যায়নীতির ভিত্তিমূল থেকে আইন, রাষ্ট্র প্রভৃতি গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় সংগঠন বিকশিত হবার প্রার্থমিক পর্যায়ে প্রচলিত ন্যায়নীতি এবং আইনের মধ্যে বেশি পার্থক্য ছিল না। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় সংগঠন পূর্ণরূপ লাভ করে এবং অতীতের অনেক ন্যায়নীতিই আইনে পরিণত হয়। মানুষ সরকার এবং রাষ্ট্র প্রণীত আইন মেনে চলে শুধু শাস্তির ভয়ে নয়। মানুষ বিবেকবোধ, প্রজ্ঞা, উচিত অনুচিত, ভালো-মন্দ বিচার করেও রাষ্ট্র এবং সরকারকে মেনে চলে। নৈতিক মূল্যবোধ সরকার এবং সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে পরিশীলিত করে, যার ফলে তারা সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন, দুর্নীতিতে লিপ্ত হন না। নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতির কর্তৃপক্ষ আমলা প্রশাসকগণের আচরণ সীমা লংঘন করে না। তারা আইন অনুযায়ী, সংবিধান অনুযায়ী কাজ করেন। সুশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই সৎ হন। দক্ষ, সৎ, দূরদর্শী, অভিজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ, জনদরদি বা জনবান্ধব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষিত, সৎ প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের অভাবে একটি রাষ্ট্র কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করতে পারে না। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থ, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থলিপ্সা, বিলাসী জীবনের প্রতি আগ্রহ মানুষকে অসৎ করে তোলে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এগুলো পরিহার করতে হবে।

 

অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া : সুশাসনের অন্যতম ভিত্তি নারী এবং পুরুষের অংশগ্রহণ। এর উদ্দেশ্য রাষ্ট্রকে অধিকতর ক্ষমতাশালী করা। অংশগ্রহণ বলতে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে জনগণের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনকে বোঝায়। এর অর্থ রাজনৈতিক শাসন কাজে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ, নীতি প্রণয়নে নাগরিকের সম্পৃক্ততা, তথ্য, মত পরামর্শমূলক কাজে জনগণের অংশীদারিত্ব, রাষ্ট্রীয় নীতি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যৌথ উদ্যেগ, যৌথ পরিকল্পনা এবং জনগণের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বনির্ভর স্ব-শাসিত করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নীতি প্রণয়নে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ সুশাসনকে গতিশীলতা দান করে। অংশগ্রহণ সম্ভবপর। যখন গভর্ন্যান্স উক্ত জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিণত হয়।

 

সার্বভৌম কার্যকর আইনসভা : আইনসভার সার্বভৌমত্ব শুধু তত্ত্বকথায় যেন পর্যবসিত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সকল সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে- আইনসভায় বসে যুক্তিতর্ক পেশ করে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আইনসভাকে বাদ দিয়ে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি দাওয়া আদায়ের কুঅভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। অকারণে, ঘন ঘন সংসদ বয়কট বা ওয়াকআউট করা যাবে না। সংসদে অনুপস্থিত থাকা সময়সীমা কমাতে হবে। সকল সদস্যের বিশেষ করে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের আলোচনার সুযোগ দিতে হবে।

 

প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা : স্বচ্ছতার অর্থ পরিষ্কার, স্পষ্ট। দ্বৈত অর্থবোধকতার অনুপস্থিতিই হলো স্বচ্ছতা। শাসন বা গভর্নেন্স এর লক্ষ্য হবে স্পষ্ট, হীরকের মত স্বচ্ছ। শাসনব্যবস্থার আইন-কানুন, নীতি বা সিদ্ধান্ত স্পষ্ট, পরিষ্কার স্বচ্ছ হলে সহজেই জনগণের বোধগম্য হয়। শাসক -শাসিতের মধ্যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী তা পালনকারীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে না। শাসনের স্বরূপ, শাসকের কাজকর্ম, প্রণীত আইন কানুন এমন হতে হবে যেন তা সকল নাগরিকের বোধগম্য হয়। এগুলো যেন কেউ ক্ষুদ্র বাক্তিস্বার্থে বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। নীতি বা সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

 

আইনের শাসন নিশ্চিত করা : সুশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন আইনের শাসন বিদ্যমান থাকে। আইনের শাসনের মূলকথা হলো- ) আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, ) সকলেরই আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ ) শুনানী ব্যতীত কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। আইনের শাসনের প্রাণভোমড়া তিনটি প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। এগুলো হলো শাসকের ন্যায়পরায়ণ আচরণ, নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ আইনের শাসন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ (নিরপেক্ষ স্বাধীন বিচার বিভাগ) আইন হতে হবে নির্দিষ্ট স্পষ্ট যেন সহজেই তা বোধগম্য হয় এবং সবাই তা পালন করতে বা মেনে চলতে পারে। আইন কার্যকর করবে আদালত। কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী বিচার কাজ চলবে না, তা চলবে আইনের আলোকে।

 

দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা : একটি রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ যেমন তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত কাজের জন্য আইন বিভাগের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে তেমনি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিস্থ সংগঠন পরিচালনার জন্য এর পরিচালকদের দায়বদ্ধ থাকতে হয়, জবাবদিহি করতে হয়। এই দায়বদ্ধতার রয়েছে দুটি দিক। যথা- ) রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ) প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা। নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করে নির্বাচকদের ম্যান্ডেট লাভ এবং তা বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদগণ যে অঙ্গীকার ঘোষণা করেন, তাকে বলে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। তেমনি প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্যও প্রশাসকদের বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারীদের দায়বদ্ধ থাকতে হয়। রাষ্ট্র পরিচালক বা সরকার থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরে জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে কার কি দায়িত্ব এবং কোন সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করতে হবে। কার নিকট জবাবদিহি করতে হবে তা পূর্বেই নির্ধারণ করতে হবে। শাসন বিভাগ বা মন্ত্রিসভাকে আইনসভার নিকট তাদের গৃহীত নীতি, সিদ্ধান্ত কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তা করতে ব্যর্থ হলে আইনসভার অনাস্থা এনে মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যাবে সেকথাও পরিস্কার করে উল্লেখ থাকতে হবে। দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলে শাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, অর্পিত দায়িত্ব দ্রুত সম্পন্ন হয়, দুর্নীতি হ্রাস পায় এবং লক্ষ্য অর্জিত হয়।

 

দক্ষ সরকার ব্যবস্থা : দক্ষতার অর্থ প্রাপ্ত সম্পদের উপকরণের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা অর্জন। অবাধ তথ্য সরবরাহ, প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে। জ্ঞান, দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব, কর্তব্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, কাজের আগ্রহ, কাজে ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ, সততা ইত্যাদি বজায় থাকলে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। সরকারকে দক্ষ, দূরদর্শী কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তথ্যের সহজলভ্যতা সৃষ্টি করতে হবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সেমিনার- সিম্পোজিয়াম করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

 

স্বাধীন বিচার বিভাগ : সরকারের তৃতীয় স্তম্ভ বিচার বিভাগ। এর লক্ষ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত বা প্রতিষ্ঠা করা। বিচার বিভাগকে আইন শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে এবং এর স্বাধীনতা নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে হাইকোর্ট আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। জেলা অধস্তন আদালতগুলোর বিচারক নিয়োগ করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। বিচারবিভাগ যদি সরকারের অন্য দুটি বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত, স্বাধীন নিরপেক্ষ থাকে, বিচারকগণ যদি সৎ, দক্ষ, নিরপেক্ষ উচ্চ নৈতিক গুণাবলির অধিকারী হন এবং ভয়ভীতি বা প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার না করেন, তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচার বিভাগই আইনের শাসনের প্রকৃত রক্ষণের ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

বিকেন্দ্রীকরণ : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে ক্ষমতার বণ্টন বিভক্তিকরণের নীতি। এর অর্থ ক্ষমতা, কর্তৃত্ব দায়িত্বকে প্রশাসনের উচ্চ স্তর থেকে নিম্ন স্তরে ছড়িয়ে দেয়া। বিকেন্দ্রীকরণ বলতে শুধু প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রত্যর্পণ নয়, একইসাথে আর্থিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা কর্তৃত্ব অর্পণকে বোঝানো হয়েছে। কোন দেশের যাবতীয় কার্যাবলী সরকারের একার পক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না, সরকারকে তার কিছু কিছু ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ে ছেড়ে দিতে হয় যার ফলে সরকারের কার্যাবলিগুলো দক্ষতার সাথে সম্পাদিত হয়। USAID এর মতে, কার্যকরী বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক সুযোগ সুবিধ প্রদান করতে পারে এবং জাতীয় রাজনীতির উন্নতিতে সাহায্য করে। বিকেন্দ্রীকরণ জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করে। জনগণ এর মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনন্দিন কার্যাবলী দেখতে পারে, ফলে দুর্নীতির সম্ভাবনা কম থাকে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র আনয়নের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতি রয়েছে। সারাদেশে বিকেন্দ্রীভূত বিভিন্ন পৌর এলাকা রয়েছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সঠিক আইনের অভাবে এবং অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কারণে স্থানীয় সরকার পদ্ধতির উন্নয়ন সম্ভব হয় না। এই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই দুর্নীতিগ্রস্ত এবং মোটেও জবাবদিহি নয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৯নং অনুচ্ছেদে বিকেন্দ্রীকরণের কথা উল্লেখ রয়েছে যেটি স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু হবে কিন্তু এটি সংবিধানেই আছে তার কোন বাস্তব প্রয়োগ নেই।

 

দুর্নীতি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ : বিশ্বের যে কোন দেশের সুশাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সরকারি অঙ্গ সংগঠনগুলো থেকে দুর্নীতি কমানো। সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরোধীতার জন্য যে রাজনৈতিক অনিচ্ছা রয়েছে, স্বাধীনতার ৩৫ বছরেরও বেশি সময়ের পর স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করা তাই প্রমাণ করে। দুর্নীতি জাতীয় সম্পদের সঠিক বণ্টনে বাঁধা প্রদান করে এবং ধনী গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে, "সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করতে পারবেন।" ন্যায়পালকে মন্ত্রণালয় যে ধরনের ক্ষমতা প্রদান করবে ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশে পর্যন্ত ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনো সংসদীয় সরকার এর প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। দুর্নীতির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করতে হবে। দুর্নীতি বিরোধী সভা-সমিতি, সেমিনার- সিম্পোজিয়াম করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি বিরোধী আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে সিলেবাসে দুর্নীতি বিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা জনগণের মনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিকে ঘৃণ্য মানসিকতা বৃদ্ধি করতে হবে।

 

মিডিয়া প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা : অধিকাংশ রাষ্ট্রেই অকারণে সম্পূর্ণ ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে সরকার মিডিয়া প্রচার যন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ফলে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ জনমত গঠনের সুযোগ নষ্ট হয়, বাক ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। সরকার আরো স্বৈরাচারী হয়। জন্য মিডিয়া প্রচার যন্ত্রের ওপর সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। গণমাধ্যম জনগণের দাবি-দাওয়া, আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটায়। সরকারের আলোচনা-সমালোচনা করার জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন দরকার, জনস্বার্থ তুলে ধরার জন্য তেমনি জনগণের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতাও দরকার। মিডিয়ার স্বাধীনতা না থাকলে দেশের প্রকৃত অবস্থা সরকারের দৃষ্টিগোচর হয় না। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। গণমাধ্যমের একটি সংবাদ মাধ্যম অপরটি জনতার মাধ্যম। মিডিয়া বা গণমাধ্যম দুই ধরনের হতে পারে- একটি Electronic Media অপরটি Print Media সংবাদপত্রের যেমন স্বাধীনতা প্রয়োজন সরকারের আলোচনা-সমালোচনা করার এবং জনস্বার্থ তুলে ধরার জন্য, তেমনি জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়।

 

সহিংসতা দূর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা : রাজপথে সহিংস আন্দোলন করে, জ্বালাও পোড়াও নীতি অবলম্বন করে, অপ্রয়োজনীয় অনাকাঙিক্ষত হরতাল সংস্কৃতি চালু রেখে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খোঁজার কু-অভ্যাস বদলাতে হবে। জাতীয় সংসদে বসে এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায়েই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। সরকারের বিরোধিতার জন্য হরতালের বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নির্বাচিত সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরানোর আশ্রয় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সুশাসনের অন্তরায়।

 

স্বাধীন কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠা : জনপ্রশাসনে নিয়োগ এবং পদোন্নতির জন্য মেধাবী যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে হবে। এজন্য নিরপেক্ষ, সৎ প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি সমন্বয়ে কর্মকমিশন গঠন করতে হবে।

 

স্বাধীন নির্বাচন কমিশন : রাজনৈতিক দল গঠন পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা, স্বচ্ছ অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।

 

জনসচেতনতা বৃদ্ধি : সুশাসন কী, কীভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে, এক্ষেত্রে জনগণ সরকারের কী করণীয় সে সম্পর্কে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য সরকারের প্রচারযন্ত্রকে সবল করে তুলতে হবে।।

 

স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালীকরণ : শক্তিশালী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় সরকারকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি এর উপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করতে হবে। এগুলোর ওপর কোনো ধরনের বাহ্যিক খবরদারি করা চলবে না। প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা জাতীয় সংসদ সদস্যদের খবরদারি না থাকাই শ্রেয়।

 

লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অগ্রাধিকার বিবেচনায় পারঙ্গমতা : সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অগ্রাধিকার বিবেচনায় পারঙ্গম দূরদর্শী হতে হবে।

 

সুশাসনের সমস্যাবলি

একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যা কখনো আকস্মিভাবে ঘটানো যায় না। একে অর্জন করতে হয় ধাপে ধাপে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিচ্ছে। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রয়েছে বহু সমস্যা।

বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ : অধিকাংশ রাষ্ট্রেই, বিশেষ করে অনুন্নত, উন্নয়নশীল সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও দেখা যায় যে, জনগণের বাক স্বাধীনতায় ক্ষমতাসীন সরকার হস্তক্ষেণ করে থাকে। জনগণ স্বাধীনতার মত প্রকাশ করতে পারে না। সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার ওপর সরকার সেন্সরশীপ আরোপ করে। এর ফলে জনগণ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে পারে না। সরকার সব সময় মুক্ত আলোচনাকে ভয় পায় এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়।

 

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং সহিংসতা : সদ্য স্বাধীন, অনুন্নত উন্নয়নশীল বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব লক্ষ করা যায় নির্বাচিত সরকার নির্ধারিত মেয়াদ শেষের আগেই বিরোধী দলগুলো সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে। এসব আন্দোলন হয়ে ওঠে সহিংস। অকারণে 'হরতাল' বা 'বন্ধ' ঘোষণা এবং পিকেটিং, জ্বালাও পোড়াও করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। ফলে সময়ের আগেই সরকারের পতন ঘটে কিব সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এর ফলে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। প্রশাসন ভেঙে পড়ে বা স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে সুশাসন ব্যাহত হয়।

 

সরকারের জবাবদিহিতার অভাব : অনুন্নত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহে এমনকি কোনো কোনো উন্নত রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। লক্ষ্য করা যায় যে, সরকারের শাসনবিভাগ তাদের কাজের জন্য আইন বিভাগের নিকট জবাবদিহি করে না। মন্ত্রী আইন সভার সদস্যগণ একই দলের হওয়ায় এবং দলীয় শৃঙ্খলার কারণে জবাবদিহিতার বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এর ফলে সুশাসন বিঘ্নিত হয়।

 

আমলাদের জবাবদিহিতার অভাব : আমলারা নিজেদেরকে জনগণের সেবক না ভেবে প্রভু ভাবেন। তারা নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণি বলে মনে করেন। তাদের মধ্যে জবাবদিহিতার মানসিকতা গড়ে না ওঠায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা সুদূর পরাহত হয়ে ওঠেছে।

 

আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা : আমলাতন্ত্রে পূর্বের মতো দক্ষ, নিরপেক্ষ মেধাবী মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার প্রাধান্য, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, আমলাদের কাজে অবাঞ্চিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, রাজনীতিকরণ ইত্যাদি কারণে আমলারা ক্রমশ অযোগ্য অদক্ষ হয়ে পড়ছে। ফলে সুশাসন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে

 

আইনের শাসনের অভাব : আইনের শাসনের মৌলিক তিনটি শর্ত রয়েছে। এগুলো হলো ) আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান, ) আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান থাকা, ) শুনানী গ্রহণ ব্যতীত কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। এই শর্ত তিনটি মেনে চললেই তবে বলা যাবে যে, আইনের শাসন কার্যকর রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ রাষ্ট্রেই আইনের শাসন কার্যকর থাকে না। আইনের শাসনের একটি অর্থ হচ্ছে নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ থেকে অন্যায়, বিশৃঙ্খলা নৈরাজ্য দূর হয়। ফলে সমাজে স্থিতিশীলতা আসে। আইনের শাসন না থাকলে সবল-দুর্বল, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান প্রকট হতে থাকে। আইনের শাসনের অভাবে রাজনৈতিক কারণে বিচার ব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ন্যায়পরায়ণ আচরণ, নিপীড়ন মুক্ত স্বাধীন পরিবেশ, নিরপেক্ষ স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকতে হয়।

 

সরকারের অদক্ষতা অব্যবস্থাপনা : অনেক রাষ্ট্রেই দক্ষ যোগ্য সরকার সব সময় দেখতে পাওয়া যায় না। সরকারের অদক্ষতা অব্যবস্থাপনা কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশে অরাজকতা চলতে দেখা যায়। এর ফলে সুশাসন ব্যাহত হয়। যথার্থ নীতি প্রণয়নে সরকারের দক্ষতা, সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা শক্ত হাতে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন, সমান সেবা বিতরণ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তৎপর হওয়া, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা ইত্যাদি হলো কার্যকর সরকার বা দক্ষ সরকারের বৈশিষ্ট্য। এগুলোর অভাব ঘটলেই ধরে নিতে হবে সে দেশের সরকার অকার্যকর।

 

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা : বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সুশাসনের বড় অন্তরায় হলো দুর্নীতি দুর্নীতির রাহুগ্রাস এসব রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলছে। দুর্নীতির কারণে সম্পদের অপচয় হয়, বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি হয় এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। UNCAC- এর ভূমিকায় বলা হয়েছে যে, "দুর্নীতি সমাজ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। কারণ এর মাধ্যমে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা বিনষ্ট হয়, ন্যায়বিচার সবার সমান অধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হুমকির মুখে পড়ে।" অধিকাংশ রাষ্ট্রেই দুর্নীতি দমন কমিশন বা ব্যুরো নামক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলো স্বাধীন কর্মতৎপর নয়।

 

রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব : সদ্য স্বাধীন, অনুন্নত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। রাজনৈতিক নেতাদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকে না, দলীয় ইশতেহারে যা লেখা থাকে তা বাস্তবায়িত করা হয় না, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা তা' পূরণ করার সদিচ্ছা থাকে না, রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনে চরম উদাসীনতা দেখানো হয়। যুক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে পেশি শক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা, শাসক বিরোধী দলসমূহের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং এর পরে দেশজুড়ে সৃষ্ট সহিংসতা সমগ্র রাষ্ট্রে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ নষ্ট হয়।

 

রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব এবং ব্যক্তিপূজা : উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। নেতা যা বলেন অধস্তন নেতা কর্মীরা তা মেনে নিতে বাধ্য হন। কেননা তা না হলে তাকে দলের মধ্যেই কোণঠাসা করে রাখা হয়, পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত করা হয় এমনকি দল থেকেই যেনতেন কারণ দেখিয়ে বহিষ্কার করা হয়। দলগুলোতে নিয়মিত কাউন্সিল করা হয় না অথবা করা হলেও নির্বাচনের পরিবর্তে দলীয় নেতার ওপরই পদপদবি বণ্টনের একান্তর ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এর ফলে একক ব্যক্তির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দলে গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। নেতা স্বৈরাচারী মনোভাবের অধিকারী হন। এরূপ স্বৈরাচারী নেতা ক্ষমতায় গিয়ে যে আচরণ করেন, যেভাবে দেশ পরিচালনা করেন তার ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকে না।

 

রাজনীতিতে সামারিক হস্তক্ষেপ : অনুন্নত উন্নয়নশীল বিশ্বে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার অনেক রাষ্ট্রেই রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ এর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ভুলুষ্ঠিত হয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয় বা অকার্যকর করে রাখা যায়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সুদূর পরাহত হয়ে পড়ে।

 

স্বজনপ্রীতি : বিশ্বের অনেক দেশেই স্বজনপ্রীতির ব্যাপক বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, সুযোগ সুবিধা বন্টন সম্মান পদবি-খেতাব প্রদান প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকার বা গোষ্ঠী স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে যোগ্য, দক্ষ মেধাবী ব্যক্তিদের সেবা সহযোগিতা থেকে রাষ্ট্র তথা প্রশাসক বঞ্চিত হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকা : স্বাধীন বিচার বিভাগ সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক। স্বাধীন বিচার বিভাগ না থাকায় বা বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেলে আইনের শাসন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুযোগ বিনষ্ট হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার শেষ সুযোগটুকুও হাতছাড়া হয়।

জন অংশগ্রহণের অভাব : প্রশাসনে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের বা মতামত প্রদানের সুযোগের অভাব, জনগণের সাথে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের অভাব, গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার অভাব, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী কার্যকর না করা প্রভৃতির ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।

 

অকার্যকর জাতীয় সংসদ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভার গুরুত্ব অপরিসীম। আইনসভ প্রণীত আইনের আলোকেই একটি দেশের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তারা জাতীয় সংসদে তুলে ধরবেন, সরকারের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করবেন এবং সমাধান নির্দেশ করবেন। কিন্তু অনেক দেশে আইনসভা দুর্বল। অনেক দেশে শাসন বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেক দেশে বিরোধ দলীয় সদস্যগণ আইনসভা বয়কট করে রাজপথে আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলীয় জাতীয় সংসদ সদস্যগণ সংসদ বর্জন করে চলেছেন। যখনই যে দল বিরোধী দলের আসনে বসেন সে দল বা জোটই সংসদ বর্জন করে রাজপথে মিছিল মিটিং হরতাল এমনকি জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সহিংস পথে অগ্রসর হচ্ছেন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সকল সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে সংসদে বসে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। ফলে জাতীয় সংসদ অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথও প্রশস্ত হচ্ছে না।

 

দারিদ্র্য : দারিদ্র্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। আর্থিক কারণে দরিদ্র জনগণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। দরিদ্র অশিক্ষিত জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব লক্ষ করা যায়। দরিদ্র অসচেতন জনগণ সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে অজ্ঞ উদাসীন থাকে। সুতরাং দারিদ্র্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা।

 

স্থানীয় সরকার কাঠামোর দুর্বলতা : সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হলো শক্তিশালী, দক্ষ কার্যকর স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা। কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রেই, বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে স্থানীয় সরকার কাঠামো খুবই দুর্বল অকার্যকর। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

 

জনসচেতনতার অভাব : জনগণের সচেতনতাই গণতন্ত্রের সফলতার মূল শক্তি। জনগণের সজাগ দৃষ্টি নাগরিক অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। এজন্যই জনসচেতনতা 'সুশাসনেরও' চাবিকাঠি। জনগণ সচেতন না হলে সরকার, প্রশাসনযন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। এর ফলে 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।

 

ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব : সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারের এক বিভাগ কর্তৃক অন্য বিভাগের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এর ফলে সরকারের কোনো বিভাগের পক্ষে স্বেচ্ছাচারী এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করার প্রবণতা বাধাগ্রস্থ হবে। কিন্তু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রেই এরূপ ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি কার্যকর রয়েছে। এর ফলে অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে 'সুশাসন' বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

 

স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অভাব : অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নির্বাচন কমিশন থাকলেও তা স্বাধীন বা প্রভাবমুক্ত এবং নিরপেক্ষ নয়। অনেক সময় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেও পারেন না। এর ফলে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠাও বাধাগ্রস্ত হয়।

 

সংবাদ মাধ্যমে স্বাধীনতার অভাব : সুশাসনের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম। স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম ছাড়া মানবাধিকার রক্ষা, মৌলিক অধিকার উপভোগে অনুকূল পরিবেশ রক্ষা, জবাবদিহিতার নীতি কার্যকর করা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সংবাদপত্রের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়।

 

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে গণতন্ত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠা বা সফল করা সম্ভব নয়। কেননা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে জঙ্গীবাদ, উগ্রতা, হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবে জাতীয় চেতনা দেশপ্রেম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানবাধিকার ভূলুষ্ঠিত হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।