সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকা
সুশাসন প্রত্যয়টি দ্বিমুখী। একদিকে সরকার, অন্যদিকে জনগণ। সরকারের কর্তব্য হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। জনগণের কর্তব্য হলো নিজেরা সচেতন হওয়া, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা ও উন্নয়ন কাজে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি জনগণের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ ও তা বাস্তবায়ন : বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার সংবিধানে সন্নিবেশ করতে হবে। শুধু তাই নয় এগুলো যেন কেউ ব্যক্তি স্বার্থে বা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে খর্ব করতে না পারে সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলো ভোগের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়া ব্যক্তি সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করতে এবং তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে না। অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলে নাগরিকের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা : প্রত্যেক নাগরিককে তার চিন্তা, মত ও বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। কেননা এসব অধিকার ব্যতীত কোন ব্যক্তি সভ্য ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে না। এসব অধিকারের অভাবে ব্যক্তিসত্তারও পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না।
শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান : সহিংসতার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেন সমস্যার সমাধান বা দাবি দাওয়া মেটানো যায় তার অনুকুল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। আলোচনার পরিবেশ তৈরি ও সবসময় তা বজায় রাখতে হবে।
দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা : দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে শাসন বিভাগ সবসময় তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও কাজের জন্য আইনসভার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। আইনসভার আস্থা হারালে পদত্যাগ করবে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার হলে সেক্ষেত্রে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।
জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সবসময় দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ করবে।
দক্ষ ও কার্যকর সরকার : দক্ষ ও কার্যকর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার দক্ষ না হলে এবং কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে কোনোদিনই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
জনসম্মতি : সরকারের কাজের বৈধতা অর্থাৎ সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি জনগণের সম্মতি থাকতে হবে।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ : সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে তৎপর হতে হবে। উচ্চাভিলাষী ও স্কুল সিদ্ধান্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত করে।
স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা : সরকারের কাজ এবং গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্ত হতে হবে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। জনগণ যেন সরকারের ইচ্ছা- অনিচ্ছা বুঝতে পারেন। এরূপ হলে সরকারি কাজে জন অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে।
একাধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি : একাধিক রাজনৈতিক দল থাকতে হবে এবং তারা যেন তাদের কার্যকলাপ স্বাধীনভাবে চালাতে পারে, মত প্রকাশ করতে পারে, সংঘটিত হতে পারে, তার অনুকুল পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন : অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে মুক্ত, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের হাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
ব্যবস্থাপনার দক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ : ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব ও আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখাতে হবে এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে এবং তা প্রচার করতে হবে।
দক্ষ জনশক্তি : আকস্মিক উদ্ভূত বিষয় মোকাবিলায় পারঙ্গম হতে হবে। এজন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।
বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে সাবধানতা : বিতর্কিত বিষয়ে সাবধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কোনো অবস্থায় যেন কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনের যথার্থ প্রয়োগ যেন ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান এবং সামাজিক মর্যাদা প্রদান, বেতন ভাতা প্রদান ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে।
আইনসভাকে গতিশীল ও কার্যকর করা : সংসদকে গতিশীল ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে। সংসদ সদস্যদেরকে সংসদে বসেই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। জাতীয় সংসদকে আইন প্রণয়নে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
স্পষ্ট ও সহজবোধ্য আইন প্রণয়ন : এমন আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করতে হবে যেন তা হয় স্পষ্ট ও সহজবোধ্য। আইন হবে সময়োপযোগী ।
ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা : সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ : সরকারকে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য বাস্তবসম্মত ও সুসমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে হবে। কোনো জঙ্গী, মৌলবাদী, অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন বিনষ্ট না হয় সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন : সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। শুধু সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করলেই চলবে না, তা বাস্তবায়নও করতে হবে।
সামাজিক ও জাতীয় আদর্শ গঠন এবং ব্যক্তিগত ও নাগরিক জীবনে সুশাসনের গুরুত্ব
আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সামাজিক ও জাতীয় আদর্শ গঠন এবং ব্যক্তিগত নাগরিক জীবনে সুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সামাজিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব : সুশাসন ছাড়া সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলা ও তা বজায় রাখা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান গঠন, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, সন্তান-সন্ততিকে শিক্ষিত, রুচিবান ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলা সম্ভব নয় কেননা এগুলো সবই সম্ভব সুশাসিত সমাজ ও রাষ্ট্রে। সামাজিক সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন নাগরিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে সমাজকে বসবাসের উপযোগী করে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বিধান করে
মানুষের সন্তুষ্টি বিধান: সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ ভালভাবে খেয়ে-পড়ে বসবাস করতে চায়। শান্তি- শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা চায়। জীবীকার সংস্থান চায়। নিরাপদ জীবনযাপনের মাধ্যমে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে চায়। মানুষের এসব স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়ার গ্যারান্টি একমাত্র সুশাসনই দিতে পারে।
সমতা বিধান: সামাজিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে অবাধে ভোগ করার জন্য সুশাসন নারী-পুরুৎ, ধর্ম-বর্ণ, উচ্চ- নীচ ভেদাভেদ করে না। শুধু তৃতীয় বিশ্বে নয়, উন্নত বিশ্বে ও পুরুষ অপেক্ষা নাইদের পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নারী শিক্ষা, নারীর কর্ম নিয়োগ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে থাকে সুশাসন।
সমাজ সেবা ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজ: সুশাসন নাগরিক সেবার রক্ষাকবচ। দুঃস্থ ও অসহায় শ্রেণি বিশেষ করে বৃদ্ধ, বিধবা, বেকারদের ভাতা প্রদান, গরিব ছাত্র- ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, কৃষক শ্রমিকদের স্বল্প সুদে ঋণদান প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়ন ও সমাজ সেবার ব্যবস্থা।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব : উন্নয়নশীল দেশসমূহকে দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক শোষণ, স্বৈরশাসন, সামরিক শাসন প্রভৃতি হতে পরিত্রানের জন্যে সুশাসনের বিকল্প নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে সততা ও সতর্কতার সাথে একজন নাগরিক তার ভোটাধিকার প্রয়োগ ও প্রার্থী বাছাই করতে পারে না, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না। কোনো সরকার ভালো কি মন্দ তা সুশাসনের মানদণ্ডে নির্ধারণ হয়ে থাকে। নাগরিক অধিকারকে অধিক গুরুত্ব প্রদান এবং কোনো কারণেই যেন অধিকার খর্ব না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখার কারণে সুশাসনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার আদায়ের প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব হয়। সুশাসন রাষ্ট্রের শাসক, শাসিত ও সুশীল সমাজের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে ও রাষ্ট্রের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ও জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এর প্রভাবে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সরকার শক্তিশালী হয়।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : আইন না মানলে শাস্তি পেতে হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। সব থেকে বড় কথা আইন মানুষের অধিকার উপভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে। আইনের উপস্থিতি ছাড়া উৎকৃষ্ট নাগরিক জীবন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে আইন সঠিকভাবে কার্যকর করা যায় না এবং নাগরিক অধিকার উপভোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সুশাসনের বিকল্প নেই। সুশাসন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত করে। এর প্রভাবে জাতীয় উন্নয়ন সুশৃঙ্খলভাবে অর্জন করা সম্ভব হয়। একটি দেশে সু-শাসন নিশ্চিত করা তখনই সম্ভব হবে যদি সেই দেশে আইন, সংবিধান, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার থাকে। আর এগুলো প্রত্যেকটি এক একটির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত, যা জনজীবনের শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুশাসন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ও নির্দেশনা প্রদান করে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব : সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সহিংস আচরণ এবং হরতাল, জ্বালাও পোড়াও নীতি অবলম্বনের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়ন সহযোগী দাতা সংস্থাগুলো মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিদেশি উদ্যোক্তারা এসব দেশে শিল্প, কলকারখানা স্থাপনে বা পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং 'অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুশাসন এবং সুশাসনের জন্য অর্থনীতি' এই প্রতিপাদ্যের আলোকে তৃ তীয় বিশ্বের রাষ্ট্র ও শাসকবর্গকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যে দেশের সুশাসন যত উন্নত সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। সুশাসনকে অর্থনীতির প্রাণশক্তি বলা হয়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অধিকার ভোগের বিনিময়ে নাগরিককে বেশ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। একজন নাগরিক যখনই কোনো অধিকার ভোগ করতে চায় তখনই এর সাথে কিছু কিছু কর্তব্য পালনের বিষয়ও চলে আসে। অধিকার ও কর্তব্য সমাজবোধ থেকে এসেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু সরকারকেই সচেষ্ট হতে হবে তা নয়। এজন্য নাগরিকেরও অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কেননা কর্তব্যবিমুখ জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
সামাজিক দায়িত্ব পালন : সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি গড়ে ওঠে নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। এগুলো হলো- সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলা এবং তা বজায় রাখা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান গঠন বা নির্মাণ এবং সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও এতে অংশগ্রহণ করা, সামাজিক সচেতনাতা বৃদ্ধি করা, সমাজে বসবাসকারী মানুষকে কুসংস্কার মুক্ত, পরমতসহিষ্ণু ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলা ইত্যাদি হলো নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব।
রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন : রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করা সকল নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্রের আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে।
আইন মান্য করা : রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আইন তৈরি হয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নততর সমাজজীবন প্রতিষ্ঠার জন্য। আইন অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়। আইন শুধু নিয়ে মানলেই হবে না, অন্যেরাও যেন আইন মেনে চলে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন : নির্বাচনে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সততা ও বিজ্ঞতার সাথে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত করা উচিত। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।
নিয়মিত কর প্রদান : রাষ্ট্র নাগরিকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করে। কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় কার্য সুসম্পন্ন হয়। নাগরিকগণ যদি স্বেচ্ছায় যথাসময়ে কর প্রদান না করে তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে এবং সুশাসন বাধাগ্রস্ত হবে।
রাষ্ট্রের সেবা করা : বাষ্ট্রের সেবা করা, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত অবৈতনিক দায়িত্ব পালন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের সেবা করা, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে কোন রাষ্ট্রীয় কাজে সহায়তা করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব।
সন্তানদের শিক্ষাদান : শিক্ষা ব্যতীত নাগরিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে না। শিক্ষা নাগরিককে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে সচেতন করে। উপযুক্ত শিক্ষা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। পিতামাতার উচিত সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কুসংস্কার মুক্ত, পরমতসহিষ্ণু ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলা , যেন তারা বড় হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ : জনগণের জন্যই রাষ্ট্র। কাজেই রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণকেই স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। যে কোনো দুর্যোগে, আপদে-বিপদে জনগণকে তা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
জাতীয় সম্পদ রক্ষা : রাষ্ট্রের সকল সম্পদই জনগণের সম্পদ। কাজেই জনসম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে জনগণকেই। হরতালের সময় আবেগবশত কিংবা দুষ্কৃতিকারী ও অসৎ নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিয় হয়ে কেউ যেন রাষ্ট্রীয় তথা জনসম্পদ ভাংচুর বা বিনষ্ট করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ধ্বংসাত্মক কাজে নিজে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যদেরকেও বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করা : দেশে যদি আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হয় বা ভেঙে পড়ে তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। এর ফলে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্যই সকল নাগরিককে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে চোর ডাকাত-দুস্কৃতিকারী, উগ্র, হিংস্র, জঙ্গীদের সন্ধান বা অবস্থান জানাতে হবে।
সচেতন ও সজাগ হতে হবে : সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকগণকে সচেতন ও সজাগ হতে হবে। নাগরিকগণ সজাগ ও সচেতন হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা তাদের অধিকার হরণ করতে পারবে না, স্বেচ্ছাচারী হতে পারবে না, সরকার দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ করতে বাধ্য হবে।
সংবিধান মেনে চলা : সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল নাগরিককে সংবিধান মেনে চলতে হবে, সবকিছুর ওপর সংবিধানকে স্থান দিতে হবে।
সুশাসনের আগ্রহ : সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকদের আগ্রহ থাকতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একজন নাগরিককে প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে, দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে, দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।
উদার ও প্রগতিশীল দলের প্রতি সমর্থন : সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিককে উদার ও প্রগতিশীল দলের প্রতি সমর্থন জানাতে হবে, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ডকে প্রশ্রয়দানকারী দল ও এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঘৃণা জানাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেন হরতাল, ধর্মঘট, জ্বালাও-পোড়াও নীতি পরিহার করে এজন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
জাতীয় উন্নয়নে সুশাসনের প্রভাব
আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুশাসন গুরুত্বপূর্ণ।
আইনের শাসনকে সুনিশ্চিত করে : সুশাসন আইনের প্রাধান্যকে স্বীকৃতি দেয় এবং ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ ও উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ করে না। আইনের চোখে সবাই সমান এই প্রতিপাদ্যের আলোকে সকলের জন্য সমান অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সুশাসন এমন এক আদর্শ ও ব্যবস্থা যে, তার প্রভাব রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে। সুশাসন আইনকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়, আইন মান্য করার সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
দুর্নীতির গ্রাস থেকে নাগরিকদের রক্ষা করে : রাষ্ট্রের রাঘব বোয়াল, স্বার্থগোষ্ঠী, উপদল এবং কুচক্রী দলের দুর্নীতির বলয় ও গ্রাস থেকে নাগরিকবৃন্দকে রক্ষা করার জন্য সুশাসন তার শক্তি ও কাঠামোকে সক্রিয় রাখে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে কাজ করায় নাগরিকবৃন্দ দুর্নীতির অভিশাপ থেকে রেহাই পায়।
সরকার গঠনে দক্ষ, যোগ্য, সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিককে উৎসাহিত করে : একবার সুশাসনের ভিত রচনা হলে কোনো দল বা শাসক গোষ্ঠী তাকে অবহেলা করতে পারে না । অবহেলা করলে তাদেরই কবর রচিত হয়। কেননা শাসিত জনগোষ্ঠী ভালো ও মন্দের বিচারে ভুল করে না। তারা তুলনা করে মতামত গঠন করে। তাই সুশাসনের অন্তনিহিত আদর্শ দক্ষ, যোগ্য, সৎ দেশপ্রেমিক নাগরিককে শাসন ক্ষমতার মঞ্চে দেখতে চায়। ফলে সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিকবৃন্দ শাসন কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহ বোধ করে। সুতরাং সুশাসনের আদর্শ ও কাঠামো সর্বদাই দক্ষ, যোগ্য, ও দেশপ্রেমিকের অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে : সুশাসন তার অন্তর্নিহিত আদর্শ ও কাঠামো দ্বারা বাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সুবাতাস বয়ে দেয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের সুনাম ছড়িয়ে দেয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রাষ্ট্রের সুশাসন ও তার প্রশংসাসূচক বার্তা প্রকাশিত হয়। তাছাড়া সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সংস্থা ও মিডিয়ায় সুশাসনের জন্য র্যাংকিং ও গুণগাণ করা হয়।
সুশাসন কৃষিবান্ধব : উন্নত বিশ্বে সুশাসন বিদ্যমান থাকায় তাদের সরকার কৃষিখাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মূলত কৃষিভিত্তিক হলেও সুশাসনের অভাবে তারা কৃষিক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। যার ফলে তাদের সরকারকে উন্নত বিশ্ব হতে খাদ্য ক্রয় বা খাদ্য সহায়ত নিতে হয়। কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগ না থাকায় তৃতীয় বিশ্ব কৃষিতে এগিয়ে যেতে পারছে না। সুশাসন সমৃদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের দেশ যেমন- মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিতে অনেক স্বনির্ভর। উল্লেখ্য, এ দুটি দেশে সুশাসন বিদ্যমান। সুশাসনের কারণেই তাদের পক্ষে স্বনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের অপরাপর দেশগুলো জমি চাষ, সেচ, বীজ ও সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিকে আজও ধরে রেখেছে। কিন্তু সম্প্রতি তৃতীয় বিশ্বের কিছু কিছু দেখে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রচলন হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা সুশাসনের অন্তরশক্তির (Core force) কারণেই ঘটছে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। কৃষি ও কৃষককে বীজ, সার ও সেচের ভর্তুকী (Subsidy) দেওয়ায় এরূপ সাফল্য এসেছে।
সুশাসন শিল্পবান্ধব : শিল্পোন্নত দেশে সুশাসন বিদ্যমান থাকার কারণে শিল্পখাত এগিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান, চীন, ভারত, কোরিয়া, মালয়েশিয়া শিল্পে অনেক এগিয়ে আছে। চীন বিশ্বের অর্থশক্তিতে পরিণত হয়েছে। চীনের ধারাবাহিক সুশাসন এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তৃতীয় বিশ্বের অপরাপর দেশগুলো শিল্পে পিছিয়ে থাকার কারণ হলো তাদের প্রযুক্তির অভাব, প্রযুক্তি পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তির অভাব, অর্থের অভাব, কাঁচামালের অভাব এবং দেশীয় কাঁচামালকে কাজে লাগানোর প্রযুক্তির অভাব, লিংকেজ শিল্পের অভাব এবং শিল্প ও উদ্যোক্তারও অভাব। একমাত্র সুশাসনই পারে তার অন্তর্শক্তি দিয়ে এসব অভাবকে দূর করতে। তৃতীয় বিশ্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই প্রথম কাজ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে এসব দেশ স্ব স্ব ক্ষেত্রে শিল্পে সমৃদ্ধ হতে সক্ষম হবে।
ব্যবসায় ও বাণিজ্যের প্রসারে সুশাসন : শাসন ব্যবস্থায় ঘুষ দুর্নীতি দূর হলে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা গেলে, পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করা গেলে এবং আর্থিক যোগান সহজ করা হলে ব্যবসা বাণিজ্যে সুফল পাওয়া সহজ হবে। তাই ব্যবসা- বাণিজ্যের উন্নয়নের জন্য সকল প্রকার রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সর্বপ্রথম কাজ হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সুশাসন কায়েম হলে ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক জোরদার হবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ই-গভর্নেন্স
ই-গভর্নেন্স এর অর্থ হলো ইলেক্ট্রনিক গভার্নমেনট। বাংলায় একে 'ইলেক্ট্রনিক সরকার বা শাসন বলা হয় । অনেক সময় একে 'ডিজিটাল গভর্নেন্স' বা অনলাইন গভর্নেন্স' নামে ও অভিহিত করা হয় । ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সাধিত হলে 'ই-গভর্নেন্স'- এর উদ্ভব ঘটে। এই মিথস্ক্রিয়া ঘটে সরকার ও জনগণের মধ্যে, সরকার ও ব্যবসায়ীর মধ্যে, সরকার ও চাকরিজীবীদের মধ্যে এবং এক সরকারের সাথে অন্য সরকারের। ই-গভর্নেন্স এ সমস্ত কর্মকাণ্ড ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পাদন করা হয় । অনলাইনের মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন তথ্য ও সেবা জনগণের কাছে সহজলভ্যভাবে পেীছে দেওয়ার নামই ই-গভর্নেন্স।
জাতিসংঘ - ই-গভর্নেন্স এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- "সরকারি তথ্য ও সেবা, ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে জনগণের নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থাই হলো ই-গভর্নেন্স"।
বিশ্বব্যাংক এর মতে- "ই-গভর্নেন্স বলতে সরকারি তথ্যপ্রযুক্তি (নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, মোবাইল প্রভৃতি) ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণ, ব্যবসায়ী এবং সরকারের অন্যান্য অংশের মধ্যে যোগাযোগের সক্ষমতাকে বোঝায়"
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ.পি.জি আব্দুল কালাম বলেন- "স্বচ্ছ, নিশ্চিত, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও অবিকৃত সেবা দেয়ার উৎকৃষ্ট মাধ্যমই হলো ই-গভর্নেন্স"
মোটকথা ই-গভর্নেন্স হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট ও কম্পিউটারভিত্তিক যোগাযোগ। এটি হলো শাসনের এমন এক পদ্ধতি যেখানে সরকারি সেবা ও তথ্যসমূহ জনগণ সহজে ঘরে বসেই পেতে পারে। ই-গভর্নেন্স এর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ ত্বরান্বিত হয়।
ই-গভর্নেন্স-এর উদ্দেশ্য : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ই-গভর্নেন্স এর লক্ষ্য হলো জনগণকে প্রদত্ত সেবার মান উন্নয়ন, সরকারি বিভিন্ন বছরের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, আইনের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত ও শক্তিশালীকরণ, জনজীবনে এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসমূহে অগ্রাধিকার উন্নীতকরণ, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান বৃদ্ধি ইত্যাদি।
·
১) ই-গভর্নেন্স- এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা।
·
২) সরকার পরিচালনা ও প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনয়ন করা।
·
৩) প্রশাসনকে গতিশীল করা।
·
৪) দ্রুত জনগণের নিকট বিভিন্ন সেবা ও সুযোগ পৌঁছে দেওয়া।
·
৫) দক্ষ ও সাশ্রয়ী পন্থায় জনগণের নিকট সেবা পৌঁছানো।
·
৬) সরকারি তথ্য ও সেবা জনগণের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া।
·
৭) প্রশাসনের দক্ষতা ও গতিশলিতা বৃদ্ধির জন্য তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগান ।
·
৮) জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি।
·
৯) ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের নিকট তথ্য প্রাপ্তিকে সহজলভ্য করা।
·
১০) দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের বা সংশ্লিষ্টতার সুযোগ সৃষ্টি।
·
১১) নাগরিকদের মধ্যে সেবার মান উন্নীতকরণ।
·
১২) জনগণকে ঘরে বসেই সেবা ও সুযোগ লাভের সুযোগ করে দেওয়া।
·
১৩) জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ।
·
১৪) তথ্য- প্রবাহে অবাধ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা।
·
১৫) গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করা।
·
১৬) ই-কমার্সের উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন সাধন করা।
·
১৭) সুশাসন নিশ্চিত করা।
ই-গভর্নেন্স-এর কার্যক্রম
বিভিন্ন তথ্য ইন্টানেটের মাধ্যমে পাঠানো: যেমন নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম, সাধারণ ছুটি, জনগণের জন্য বিভিন্ন ঘটনার দিন তারিখ, বিভিন্ন ইস্যুর ব্যাখ্যা, নোটিশ ইত্যাদি।
সরকার ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বিমুখী যোগাযোগ: এই প্রক্রিয়ায় যেকোনো ব্যক্তি যেকোনে প্রতিষ্ঠানের সাথে ইন্টারনেট সংলাপে বসতে পারে এবং তাদের সমস্যা, মন্তব্য ও অনুরোধ প্রতিষ্ঠানায় জানাতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের লেনদেন পরিচালনা: যেমন আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া, চাকরির জন্য আবেদন চালা ও তা জমা দেয়া এবং অনুদান চাওয়া ও তা পূরণ করা।
সরকার পরিচালনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ: জনগণ ইলেকট্রিক ব্যবস্থার সাহায্য গ্রহণ করে, তথ্য প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে।
সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ই-গভর্নেন্সের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সুশাসনের লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য ই-গভর্নেন্স এর লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। আধুনিককালে ই-গভর্নেন্স ছাড়া সুশাসনকে কল্পনাই কর যায় না। ই-গভর্নেন্স মূলত সুশাসনের সহায়ক শক্তি ও সমর্থক। ই-গভর্নেন্স সরকার ও নাগরিকের যোগাযোগ সহজ করে।
অংশগ্রহণমূলক: সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো অংশগ্রহণভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। ব্যাপারে ই-গভর্নেন্স অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। ই-গভর্নেন্সের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি জনগণকে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে, উৎসাহিত করে এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রাকে বৃদ্ধি করে।
জবাবদিহিতা: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুশাসনের প্রাণশক্তি। সরকারের এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অবাধ তথ্য প্রবাহ হতে তথ্য সংগ্রহপূর্বক ক্রয়-বিক্রয় ও দায়িত্ব পালনের চিত্র জনসম্মুখে তুলে ধরে জবাবদিহিতা অর্জনে সাহায্য করে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করে।
দক্ষতা বৃদ্ধি : সুশাসনের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ার ব্যাপারে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ই-গভর্নেন্সের জুরি নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে অতি সহজে কার্যকর প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণকে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় এবং শাসন ব্যবস্থার দক্ষতা জোরদার করা যায়।
দুর্নীতি প্রতিরোধ : ই-গভর্নেন্স দুর্নীতি দূরীকরণের ব্যাপারে আদর্শিক ও কাঠামোগত শক্তিশালী শাসন বাবস্থার নিয়ামক। জনপ্রতিনিধিবৃন্দ যাতে দুর্নীতি করতে না পারে সেজন্য তাদের সম্পদের হিসাবের তথ্য আগাম সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা করে। ফলে জনপ্রতিনিধিগণ সহজে দুর্নীতি করতে পারে না। কারণ দুর্নীতি করলে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। এতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বচ্ছতা : তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও অধিকার নিশ্চিত করা সুশাসনের লক্ষ্য। এ ব্যাপারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যা ই-গভর্নেন্সের মাধ্যমে সরকার ও নাগরিকবৃন্দের মধ্যে জানাজানির সেতুবন্ধন রচনা করে। এতে সরকারের কাজের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং জনগণের ভুল বোঝার অবকাশ থাকে না।
সুশাসনের উপকারিতা
·
১) সুশাসন রাষ্ট্র ও সমাজের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং বিশৃঙ্খলা দূর করতে সাহায্য করে।
·
২) সুশাসন সামজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলে।
·
৩) সুশাসন জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে।
·
৪) রাষ্ট্রের শাসক শাসিত ও সুশীল সমাজের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধি আনয়ন করে।
·
৫) সুশাসন নাগরিক অধিকারকে অধিক গুরুত্ব দেয় এবং কোন কারণেই যেন অধিকার খর্ব না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখে।
·
৬) সুশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
·
৭) সুশাসন জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত করে।
·
৮) সুশাসন জাতীয় উন্নতিকে বাধামুক্ত রাখতে সহায়তা করে।
·
৯) সুশাসনের প্রভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।
সুশাসনের অভাবজনিত ফলাফল
·
১) সুশাসনের অভাব দেশের মেধা সম্পদের অপচয় ঘটায় ও জাতীয় উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে।
·
২) সুশাসনের অভাবকে জিইয়ে রেখে ব্যক্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়।
·
৩) সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলা ও বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
·
৪) সন্তান-সন্ততিকে শিক্ষা প্রদান, রুচিশীল ও সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তোলা সম্ভব হয় না।
·
৫) সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখে দেয় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না।'
·
৬) নাগরিক অধিকার ভোগে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় ও সততার সাথে ভোটাধিকার প্রয়োগ ও প্রার্থী বাছাই করতে পারে না।
·
৭) জনগণ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না ।
·
৮। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টের সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মানুষের মনোবল ভেঙ্গে যায়, হতোদ্যম ও নিরাশ হয়ে পড়ে।
সুশীল সমাজ
সুশীল সমাজ (Civil Society) বলতে অরাজনৈতিক, অলাভজনক বেসরকারি সংগঠনকে বোঝায় যা জনগণের স্বার্থের পক্ষে কাজ করে। এর লক্ষ্য রাষ্ট্র, সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক গোষ্ঠী।সুশীল সমাজ সুশাসনের প্রত্যয়গুলো (সামা, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, দায়িত্বশীলর স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতা) রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সচেতন ভূমিকা পালন করে। সুশাসনের উপাদান কার্যকর করার জন্য এরা শাসকগোষ্ঠী ও বিরোধী দলকে পরামর্শ দেয় এবং সংবাদ মাধ্যম ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে উজ্জীবিত করে। সুশাসনের মানদন্ড ও বিচার বিশ্লেষণ করে সুশীল সমাজ শাসকগোষ্ঠীর প্রশংসা ও সমালোচনামূলক তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করে। বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বশীল সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর মধ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), Camb for Policy
Dialogue (CPD), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), বেলা, পবা অন্যতম।
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হল এমন এক দল ব্যক্তির সমষ্টি, যারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকে। অধ্যাপক ফাইনার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে লবী (Lobby) এবং এলান পটার এটাকে 'সংগঠিত গোষ্ঠী' বলে (Organized group) আখ্যায়িত করেছেন।
·
অধ্যাপক মাইরন উইনারের মতে- "চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো কোন স্বেচ্ছামূলক সংগঠিত গোষ্ঠী যা সরকারী কাঠামোর বাইরে থেকে সরকারী কর্মকর্তাদের মনোনয়ন ও নিয়োগ, সরকারী নীতি গ্রহণ , পরিচালনা বা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।"
·
অ্যালান বলের মতে- "চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হল এমন একটি গোষ্ঠী যার সদস্যগণ 'অংশীদারী মনোভারের দ্বারা আবদ্ধ।"
·
এইচ জিগলার এর মতে- "চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হচ্ছে এমন একটি সংগঠিত ব্যক্তি সমষ্টি যার সদস্যগণ সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগে অংশগ্রহণ করে না। বরং তাদের লক্ষ্য হল সরকারি সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করা।
·
অ্যালমন্ড গ্যাব্রিয়েল ও জি পাওয়েল বলেন- "স্বাথগোষ্ঠী বলতে আমরা নির্দিষ্ট স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ অথবা সুযোগ-সুবিধা দ্বারা সংযুক্ত এমন এক ব্যক্তিসমষ্টিকে বুঝি যারা এরূপ বন্ধন সম্পর্কে সচেতন।"
মোটকথা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হল এমন এক জনসমষ্টি যারা সমজাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার উপরে প্রভাব বিস্তার করে। ক্ষমতা দখল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য নয় বরং নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করাই এর উদ্দেশ্য। সরকারি নীতি নির্ধারণে চাপ প্রয়োগ করে গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা করাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রধান উদ্দেশ্য।
অধ্যাপক এলান আর বল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সমভাবাপন্ন সদস্যগণের সমন্বয়ে গঠিত গোষ্ঠীকে বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে ২ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
·
(১) স্বার্থকারী গোষ্ঠী
·
(২) সমদৃষ্টিসম্পন্ন (গোষ্ঠী।
অধ্যাপক অ্যালমন্ড ও পাওয়েল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এক ধরনের স্বার্থকামী গোষ্ঠী বলে অভিহিত করেছেন। তারা সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে ৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যথা-
·
(১) স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থগোষ্ঠী
·
(২) সংগঠনভিত্তিক স্বার্থগোষ্ঠী
·
(৩) সংগঠনহীন স্বার্থগোষ্ঠী
·
(৪) প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠী।
সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তৈরি করতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে শিল্পপতি, পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সর্বাপেক্ষা-শক্তিশালী চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গঠন করে। সাধারণত শাসন বিভাগে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অধিক মাত্রায় প্রভাব প্রতিফলিত হয়। যুক্তরাজ্যের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নীতি নির্ধারণী কমিটিতে প্রায়ই চাপ প্রয়োগকারী সদস্যদের স্থান দেওয়া হয়।
ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অর্থ সরকারের তিনটি বিভাগ (আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ)-এর ক্ষমতা ও কাজকে পৃথক বা স্বতন্ত্র করে দেয়া। এক বিভাগের কাজ অন্য বিভাগের কাজ থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র হবে। প্রতিটি বিভাগ তার নিজস্ব কর্মক্ষেত্রের মধ্যে স্বাধীন থাকবে। এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে বাধা প্রদান বা হস্তক্ষেপ করবে না। এই নীতি অনুসারে আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করবে, শাসন বিভাগ সেসব আইন কার্যকর করবে এবং বিচার বিভাগ সেসব আইনের ব্যাখ্যা দান এবং বিভিন্ন মামলায় প্রয়োগ করবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের মূল উদ্দেশ্য জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করা। ১৭৪৮ সালে ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তাঁর "The Spirit of
Laws" নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে সর্বপ্রথম পরিপূর্ণভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যাখ্যা করেন।
বাংলাদেশ ও সুশাসন
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে মহান স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা লাভের পর গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে সুশাসনে রূপ দিতে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয় । বাংলাদেশের সংবিধান ৪ নভেম্বর , ১৯৭২ সালে গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সাল হতে কার্যকর হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বহু ধারা ও অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নকশা প্রদান করে।
শুদ্ধাচার চর্চা : শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয় । ব্যক্তি পর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্রনিষ্ঠা। শুদ্ধাচার চর্চা ও দুনীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করে।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্বরূপ : কোনো দেশের বিভিন্ন এলাকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকাতে কর আরোপসহ সীমিত ক্ষমতা দান করে যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়, তাকে স্থানীয় সরকার বলে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার কাঠামো লক্ষ করা যায়। যথা- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ। এছাড় রয়েছে শহরগুলোতে পৌরসভা, বড় শহরে সিটি কর্পোরেশন।
জেলা পরিষদ: স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর। কার্যকাল ৫ বছর। ১ জন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য এবং সংরক্ষিত আসনে ৫ জন মহিলা সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদ গঠিত হয়। তাঁরা সকলে পরোক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
উপজেলা পরিষদ: ১৯৮২ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ বলে থানা পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালে অধ্যাদেশটি সংশোধন করে বিদ্যমান থানাসমূহকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। উপজেলা পরিষদে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। ২৬ জানুয়ারি, ১৯৯২ জাতীয় সংসদে 'উপজেলা বাতিল বিল’ পাস হয়। ৬ এপ্রিল, ২০০৯ জাতীয় সংসদে 'উপজেলা পরিষদ (রহিতকরণ) আইন পুনঃপ্রচল ও সংশোধন বিল' পাস হয়। ১ জন চেয়ারম্যান, ২ জন ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপজেলার আওতাধীন ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যানবৃন্দ, পৌরসভার মেয়র (যদি থাকে) এবং ৩ জন মহিলা সদস্যের সমন্বয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়। চেয়ারম্যান উপজেলার ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।
ইউনিয়ন পরিষদ: পল্লী অঞ্চলে নিম্নতম স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। স্থানীয় সরকার কাঠামোর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদকেই সবচেয়ে কার্যকর ইউনিট বলে মনে করা হয়ে থাকে। এই পরিষদে ১ জন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, নয়টি ওয়ার্ড থেকে ৯ জন নির্বাচিত সাধারণ সদস্য ও ৩ জন নির্বাচিত মহিলা সদস্য (সংরক্ষিত আসনে) রয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান করা হয় ১৯৯৭ সালে। একটি ইউনিয়ন ৯ টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। মহিলা সদস্যগণ প্রতি ৩ ওয়ার্ডে ১ জন – এই ভিত্তিতে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যকাল ৫ বছর।
পৌরসভা (Municipality): শহরাঞ্চলে নিম্নতম স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পৌরসভা। পৌরসভা চেয়ারম্যান বা সদস্য অপসারণের জন্য ২/৩ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের পৌরসভাগুলোকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে শ্রেণি বিভাগ করা হয়।
সিটি কর্পোরেশন
(City Corporation): বাংলাদেশে মোট ১২ টি সিটি কর্পোরেশন আছে। যথা- ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ। সিটি এলাকায় ক্ষুদ্রতম প্রশাসনিক একক ওয়ার্ড। একজন মেয়র, নির্ধারিত ওয়ার্ডের সমানসংখ্যক কাউন্সিলর এবং নির্ধারিত ওয়ার্ডের এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যক সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর নিয়ে সিটি কর্পোরেশন গঠিত হয়। মেয়র ও কাউন্সিলরগণ জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এবং সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলরগণ নির্বাচিত হন কাউন্সিলরদের ভোটে। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ ৫ বছ